Thursday, June 22, 2017

অসময়ের পত্র - ১ (পত্রোপন্যাস)


প্রিয় পলি,

বড় অসময়ে লিখতে বসলাম। সবাই কি সুন্দর শান্ত, স্নিগ্ধ ঘুমে মগ্ন। রাত আর আমার সাথে বেশ একটা সন্ধি হয়েছে বহু বছর ধরে। সে জাগে, আমি জাগি। আমাদের সময়টাই পৃথিবীর অসময়। বাইরে ঝিঁ ঝিঁ পোকাও জাগছে- আমাদের সাথে সাথে। সে আমাদের পথের তাল, মাত্রা, ছন্দ। কখনো সময় নিয়ে বসে এই রাতটাকে কি গায়ে মেখেছো? এর নিঃসঙ্গতার সুবাসকে কি অনুভব করতে পেরেছো কখনো? কখনো কি দেখেছো একটা আলাদা অস্তিত্ব, একটা পূর্ণ একক সত্ত্বা নিয়ে রাত কিভাবে তোমার সাথে এসে দাঁড়ায়?

নৈশব্দের সমানত্মরালে যে পথ গেছে চলে
আঁধারের বুক চিরে আঁধারে আঁধারে
সেই খানে পদচিহ্ন মোর গেছি আঁকি
তারপরে.....

তারপরে মনে হয় কাউকে বলি এই রাতের কথা। আকাশে ছড়িয়ে থাকা ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বপ্নগুলোর কথা। সময়ের এপার ওপারে আঁকা যত আল্পনা আঁধারের বুকে জমাট হয়ে নিঃসঙ্গতায় রোদন করে তাদের কথা। হোক না অসময়, ইচ্ছে করে কিছু না বলা কথা- বলাই যাক না হয়- নিঃশব্দতার অক্ষরে।

তাই সবার অসময়ে আর আমার সময়ে আমি লিখছি। অবশ্য তোমাকে সময়মত লেখার অভ্যাসটা বহু আগেই আমি ত্যাগ করেছি, বলতে পারো ত্যাগ করতে হয়েছে। সময় নিয়ে নরক গুলজার করার মতো সময়ই যে আমার হাতে নেই। বহুকাল আগে, প্রায় বিস্মৃতির ওপারের একটা সময়ে তোমার কাছে একটা পত্র পাঠিয়েছিলাম। আমার সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ পত্রটাকে তুমি খুলেও দেখোনি, নিছক একটা গতানুগতিক প্রেমপত্র ভেবে, নাকের জল চোখের জল এক করে কেঁদে কেটে অস্থির। কি অসময়টাই না ছিলো সে সময়! তারপর থেকে বরঞ্চ অসময়ে পত্র লেখাটাই অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

লিখি আর হারিয়ে যাই। সময় হারিয়ে ফেলে মাত্রা, আমি হারিয়ে ফেলি আজকের আমিকে। হারিয়ে যাই সেই সময়ের সেতুটাকে পার হয়ে অতীতের কোন এক ধূসর প্রাঙ্গণে। তাতে রং আসে, রূপ আসে, প্রাণ আসে, দৃশ্য আসে- সময়ের ক্যানভাস আবার ভরে উঠে কানায় কানায়। আবার ফিরে আসে কালের মঞ্চে একটুকরো স্মৃতি- তার সুখ, তার অনুভূতি, তার বেদনা নিয়ে। এই ধরো, এখন যে অনুভূতিটা আসছে- তা একটা কিশোরের কিছুটা অনুতাপ, কিছুটা বোকা বোকা মনস্তাপের রঙ্গে আঁকা একটা দৃশ্য নিয়ে। আমি দেখছি একটা কিশোরীর বিচলিত মুখ। আমার চিঠি তোমার হাতে, তুমি দ্বিধাগ্রস্ত হৃদয়ে হাতে নিয়ে আবার ফিরিয়ে দিতে ব্যকুল। তোমার চোখে জল, হৃদয়ে আশাভঙ্গের বেদনা তার যন্ত্রণাকাতর ছাপ ফেলছে তোমার কপালে, কপোলে, চোখের ভ্রুতে। এক অব্যক্ত বেদনার বোঝা মুহুর্তের মধ্যে তোমার হৃদয়ে এনে দিচ্ছে অসহ্য বিস্ময়কর অজানা এক অনুভূতি। তুমি বুঝতে পারছো না, কি করতে হবে। অজানা আশঙ্কা, অযৌক্তিক ভয়। তারপর ক্ষোভ, ঘৃণা, ক্রোধ, গ্লাণি আরও কতরকমের অনুভূতির জন্ম তোমার মধ্যে! অনুভূতির ঝর্ণাধারা। আর এই ঝর্ণার স্রোতে ভেসে গেলো আমাদের চির-চেনা পথ। এরপর থেকে আমরা চিরজীবনের জন্য বাকরূদ্ধ, মুখ দেখাদেখি বন্ধ। আগেও দুজনের দুটি পথ ছিলো, এবার তা আরে মোক্ষমভাবো- “দুইদিকে গেছে বেঁকে”। তাই বলে থেমে থাকিনি, এতটা হতোদ্যম আমাকে কোন কালেই ভেবো না। বহুবার, বহুসময় এরপর তোমাকে পত্র লিখেছি, অসংখ্য পত্র। হয়তো হাস্যকর তার বিষয়বস্তু- কৌতুকপ্রদ তার পটভূমি কিন্তু সীমানাবিহীন তার গতি, বাঁধা-বন্ধনহীন তার যাত্রা। ধরো, রেলের জানালার কাছে বসে আছি, মৃদু হালকা মোলায়েম বাতাসটা আমার বাউন্ডুলে চুলে কোন আঁকি বুকি কাটছে আর হঠাৎ শুরু হয়ে গেছে পত্র লেখা, হয়তো কোন মুভি দেখছি- মনে হচ্ছে, আরে! এটাতো কাউকে না বললেই নয়- ব্যস, এবার মুভি মাথায় উঠলো। কিংবা কোথাও বন্ধুদের সাথে গেছি বেড়াতে, সামান্য একটা কিছু- হোক তা একটা ফুলের রং কিংবা একটুকরো মেঘের আকৃতি, কিংবা ঘাসের মাথায় রংধনু আঁকা শিশির, অথবা সরষে ফুলের হলদে রেণুর পরশ, দুরের সীমান্ত-প্রহরী গাছের সারির স্যালুট, নারকেল গাছের পাতায় বৃষ্টির আঁকিবুকি, ধূসর মাঠের বুকে একে বেকে চলা আ’লের কারুকাজ, মেঠো রাস্তার চারপাশে কুয়াশার চাদর, সবুজ ধানের বনে বিকেলের রোদ- সবকিছু যে তোমাকে জানাতেই হবে! সেদিন চমকে উঠলাম তোমার বান্ধবী উমার একটা ফেইসবুক পোস্ট দেখে। আমার খুবই প্রিয় এক গায়কের গানের কয়েকটা লাইন,

There’s so many times I’ve let you down
So many times I’ve played around
I tell you now, they don’t mean a thing
Every place I go, I’ll think of you
Every song I sing, I’ll sing for you
.......
প্যাট প্যাট করে আমার কথাগুলোই বলে গেছে। নিজের কথা অন্য কারোর মুখে শুনলে ভালো লাগে, অনেক ভালো লাগে। মনে হয়-

”অশেষের বৈতরণী পরে,
একা নই;
নিঃসঙ্গতার মাঝে হৃদয়ের ঘ্রাণ ভেসে আসে,
তারপরে-
শ্রুত হয় পূর্ণতার অসীম আহ্বান”

অবশ্য এই বৈতরণীতে সবাই তার নিজের গানই গায়- কিন্তু তবুও তো একটা অনুভূতির স্পর্শ। সেটাই বা কম কিসে? আমার কোন অনুভূতির স্পর্শই হয়তো তুমি সহ্য করতে পারবে না। কিন্ত তোমার নেবার ক্ষমতা না থাকলেই যে আমার দেবার ক্ষমতায় থাকতে হবে না, তা কেন? ছোটবেলায় কি জলে নৌকা ভাসাও নি? কাকে দিয়েছ অত শত কাগজের নৌকাগুলো! অসীম যত্নে সাজানো ঐ কাগজের ফুলগুলোতো সব জলেই গেছে। আনন্দটা কিন্তু জল পায়নি তুমিই পেয়েছো। আমার পত্রের নৌকাগুলোও না হয় জলেই যাক, আমি তো ভাসাতে পেরেছি! আমার শূণ্য প্রাণের বিষাদ-বিধুর-আনন্দ।
কেন জানি সবসময় মনে হয়, সমস্ত পৃথিবীতে তিল তিল করে ছড়িয়ে থাকা স্বস্তিগুলো দেখার, খুঁজে বের করার দৃষ্টি এই বড় হওয়ার প্রতিযোগীতায় নিমগ্ন সমাজের বড় বড় মানুষদের খুব একটা নেই। আমি দেখি, আর সাথে তোমাকে দেখাতে ভালো লাগে। অনুভূতি আর যুক্তির দ্বন্দ যে চিরকালীন, শাশ্বত! তাই বোধ হয় এই অযৌক্তিক ধারণার অবতারণা। মনে হয়, তুমি বোধহয় এখনো বড় হওনি, অন্তত এত বড় হওনি যে, এই ছোট ছোট নিস্পাপ প্রশান্তিগুলো তোমার চোখ এড়িয়ে যাবে। মনে হয়, তুমি এই ছোট-খাট সুখগুলোর গুরুত্ব বুঝতে পারবে। আর ভাল লাগার এই মুহূর্তগুলোর কথাই বা শুধু বলছি কেন? যখনই একটি ক্ষুধার্ত মুখ দেখেছি, দেখেছি অবহেলিত, ক্রন্দনরত কোন শিশু, অভিমানী কোন বেকারের মৃতদেহ, লাশ হয়ে যাওয়া প্রতিবাদী মুখ, সংগ্রামী পিতার কঠোর হাত- সাথে সাথে তোমাকে জানাতে কার্পন্য করিনি। যখনই কোন মানুষকে দেখেছি হাসিমুখে, আনন্দপূর্ণ প্রাণে কারো হাত ধরছে, তোমার কথা মনে পড়েছে। আবার কেউ কারো হাত ছেড়ে দিলেও তোমাকে ছাড়া আর কাকে মনে করবো বলো? কাকে জানাবো এত সব কথা! এগুলোই যে তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম। কান পেতে শোনোনি- তাই ভাসিয়ে দিচ্ছি প্রাণের শব্দ-ভেলায়।

সময়ের কি আসলেই কোন হিসাব আছে! অনাদি থেকে অনন্তে তার গতি। অসীম তার স্রোত- আর আমরা তাতে ভেসে যাওয়া কি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অস্তিত্ব! কিন্তু এই অলক্ষ্যে ভাসতে থাকা অস্তিত্বও কিন্তু সময়ের সাথে পাল্লা দেয় অবশেষে। মানুষের মধ্যে যে অসীম আছে, ক্ষুদ্র মানুষের মাঝে যে মহৎ অনুভূতি, চেতনার শক্তি আছে, তাকে কি সময় পরাজিত করতে পারে? প্রায় কুড়ি বছর আগে যে স্মৃতি, যে অনুভূতি, যে স্পন্দন অনুভব করেছিলাম- ম্লান হলো না তো কোনভাবে! সময়টা কিভাবে পরাস্ত হলো, তাই মাঝে মাঝে ভাবি। আমি কাউকেই হারাতে চাইনি, কারো সাথেই প্রতিযোগীতা করিনি কিন্তু সময়ই একলা এসে পরাজিত হয়ে গেলো। কি খামখেয়ালী তার চলন! কাজেই এই পরাজিত সময়ের পরোয়াই বা করে কে! আর প্রয়োজনই বা কি? তাই যখন ইচ্ছে হয়, তখনই লিখি- সময় আমার দাস, আমিই আমার প্রভু।

সেসময় কিন্তু আমার এই প্রভুত্ব ছিলো না মোটেও। কি লুকোচুরিই না খেলেছে সময় আমার সাথে। একটু প্রার্থনা করেছি তার কাছে, তোমাকে দেখতে পাবার, তোমার কন্ঠস্বরের স্পর্শ পাবার, একবার তোমার কাছে আমার নিজের অনুভূতি, আমার চিন্তা, আমার দেখাগুলোকে প্রকাশ করার। কিন্তু সে-ই তখন বেশ করে প্রভুত্ব ফলিয়েছে আমার উপর। আর যখন সে বললো- এখনই আমাকে পাবে, আর নয়। আমি পত্র পাঠালাম তোমার কাছে, কারণ সময় তো নেই! কিন্তু তুমি আমার পত্রকে ফিরিয়ে দিলে একবার না পড়েই। সময়টা হারিয়ে গেলো।

আচ্ছা, এত ঘাবড়িয়েছিলে কেন তুমি? প্রেমপত্র পাঠিয়েছিলাম বলে? প্রেমপত্র কাকে বলে? পত্রের সাথে ভালোবাসার মিশ্রণ, নাকি তাতে ভালবাসার প্রস্তাব? যদি আগেরটা হয় তবে তোমাকে পাঠানো আগের পত্রগুলোও তো প্রেমপত্র! আর তা না হলে পরেরটাও নয়।

তবু আবার যেন একই সংকটে বা সন্দেহে না পড়তে হয় সেজন্যই এই ষোল বছরের দূরত্ব। এতদিন বাতাসে লিখেছি, এখন ডায়েরীতে লিখছি। আমার এই পত্রগুলোকে তুমি প্রেমপত্র বা প্রেমহীনপত্র অথবা জ্বরো-রোগীর এলোমেলো প্রলাপ, মোহাচ্ছন্ন বাচালের বিচ্ছিরি বকোয়াজ- যাই-ই বলো না কেন, আর যত ক্রোধ-ক্ষোভ-বিক্ষোভ-বিদ্রোহ-কলহ দিয়ে হৃদয়কে পূর্ণ করো না কেন- তোমাকে লিখতে যে আমাকে হবেই। হয়তো তোমার মনে প্রশ্ন জাগবে, কেন লিখতে-ই হবে। কারণটা আজ বলবো না। ওটা না হয় পরেই জেনে নিও।

আবার কোন একটা খেয়ালী সময়ে হয়তো মনে হবে, এখন তোমাকে বলা যায় কারণটা। তখন তুমি জানবে, এখনকার মতো, জানতে না চাইলেও জানবে। এ পর্যন্ত আমাকে ভাসতে দাও আমার কক্ষপথে।

                                                                                                                                          ইতি,
                                                                                                                                          রতন

No comments:

Post a Comment