কল্পনার
হাঁস সব; পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রং মুছে গেলে পর
উড়ুক উড়ুক তা’রা হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর।
উড়ুক উড়ুক তা’রা হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর।
প্রিয় পলি, উত্তরা,
ঢাকা
রাত্রি: ২:০০ টা
রাত্রি: ২:০০ টা
আজকে আবার সেই খেয়ালি সময়ের একদিন, যেদিন তোমাকে আরো
কিছু জানাতে ইচ্ছে করছে। তোমাকে বলেছিলাম- কেন তোমাকে আমার লিখতেই হবে, জানাবো। আজকেই
নাহয় জানাই। তা না হলে, হয়তো তোমার ঐ অগ্নিপ্রসারী বিক্ষোভ আরেকটু উল্লম্ফিত হবে; এমনিতেও
যতটুকু জানি, রাগপ্রধান সঙ্গীত ভালো না বাসলেও, নিজে রাগপ্রধান হতে কার্পণ্য করো না।
বেশ কয়েকটা প্রেমপত্র প্রাপ্তির সৌভাগ্যও তুমি মিস করেছো তোমার এই ঝড়ো-বিক্ষুব্ধ মেজাজের
কারণে। ভালোই হয়েছে অবশ্য, আরো কয়েকবার বেচাল কান্নাকাটির হাত থেকে বেঁচে গেছো। হয়তো
শেষমেষ দেখবে কারণটা বেশ সামান্য, কিন্তু আমার কাছে যে তা চিরদিনই যে অসামান্য!
তুমি সাংঘাতিক প্র্যাকটিক্যাল মানুষ, আমি জানি। তবে
এটাও মনে হয়, পৃথিবী সম্বন্ধে তুমি খুব বেশি কিছু জানো না। জানলেও ভুল জানো। তুমি যে
পরিবেশে, যে সমাজে, যে অবস্থায় জন্মেছো, বড় হয়েছো- এই ধুরন্ধর পৃথিবীর অনেক জ্ঞান ও
শিক্ষা সেই অবস্থায় এই বিশেষ জ্ঞানলাভের জন্য উপযুক্ত নয়। তবে আমি প্রার্থণা করি, এই
জ্ঞান ও শিক্ষাগুলো থেকে তুমি শতহস্ত দূরে থাকো। দুঃস্বপ্ন দেখার চাইতে স্বপ্ন না দেখাই
ভালো। যে জ্ঞান পীড়া দেয়, হৃদয়কে দহন করে, পৃথিবী ও তার তাবৎ সম্পর্ক, পারস্পরিক ভালোবাসা
সম্বন্ধে মানুষকে সন্দিহান করে তোলে- সে জ্ঞান না থাকা যে কতটা প্রশান্তিদায়ক- সেটা
যারা এই বিশেষ জ্ঞানে জ্ঞানী কেবল তারাই উপলব্ধি করতে পারে। হয়তো তাতে ঠকবে, সম্পর্কের
প্রতারণাগুলো ধরতে পারবে না কিন্তু বিশ্বাস করে, ঠকেও যে জয় হয়, লাভ হয়, যে পূর্ণতার
আনন্দে হৃদয় উদ্ভাসিত হয়- অবিশ্বাস করে জিতেও
যে তা পাওয়া যায় না। যাই হোক, তোমাকে কারণটা জানানোর জন্য আমি ধান ভাঙ্গতে শিবের গীত
শুরু করছি। তুমি ছাড়া আর কাউকে গান শুনিয়ে আরাম পাই না বলেই হয়তো এই কৌশল!
তোমাকে কারণটা জানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কত দ্বিধা
এসে যে ভর করে- তা তোমাকে কি করে বলবো? মনে হয়- কি হবে এত কথা, এত শব্দ সৃষ্টি করে।
পৃথিবীতে তো কেবল কথা আর শব্দই সবকিছু গ্রাস করে নিয়েছে। আজকে যেন কুয়াশারাও শব্দ
করে পড়ে! জীবনানন্দ নেই, আজ যেন আর জীবনানন্দের পৃথিবীটাও নেই। মানুষ কেবল কথাই বলে
যাচ্ছে- প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে, বাঁচার তাগিদে, বাঁচানোর তাগিদে।
সময়ের পটে অলক্ষে তো কত কথাই থাকছে, ভেসে যাচ্ছে, হারিয়ে
যাচ্ছে- লক্ষ কোটি মানুষের লক্ষ কোটি কথা। তবে মনে হয় কি জানো? কোন না কোনভাবে কথা
তার গন্তব্য খুঁজেই নেয়- হয়তো অন্য কোন সময়ে, অন্য কোন হৃদয়ে, অন্য কোন খানে। হয়তো
মূল্যহীনের তালিকায় থেকে থেকেও সে মূল্যবান হয়ে জমে থাকে। তারপরও ভাবি, যেখানে অস্ত্বিত্ব
হারায়, সৃষ্টি হারায়- সেখানে এই মূল্যবিহীন কথা, শব্দের আল্পনা এঁকে কি লাভ? পরেই মনের
ভেতর কেউ একজন প্রশ্ন করে- তবে না এঁকেই বা কি লাভ? লাভ-ক্ষতির খেরো খাতা খুলেই তো
জীবন পাড়ি দিচ্ছো, এবার না হয় একদম লাভহীন, নিষ্কর্ম কিছু কর্ম করা যাক; যার কোন মূল্য
নেই- সৃষ্টিছাড়া বাতিকের কাঁরূকাজ। ছকের বাইরে না হয় একবার পা ফেলে দেখা যাক।
এই তো কিছুদিন আগে, আমার এক বন্ধু, যার সময়ে অসময়ে
বেশ হারিয়ে যাওয়ার বাতিক আছে। সে-বার সে ফেরার পর দেখলাম, আমাকে তার এই পাগলামীর জন্য
আফসোস করে কোন একটা কৈফিয়ত দিতে চাচ্ছে। শুনিনি ওর কথা। ওর এই হারিয়ে গিয়ে ফিরে আসাই
যে আমার ভালো লাগে। এ কারণেই হয়তো হঠাৎ বলে ফেললাম, “এভাবেই থাকো, পরিমিতি-জ্যামিতি
দিয়ে মেপে মেপে করা হাসি-কান্নার ছকের বাইরে। কষ্ট পাবে, কিন্তু তুমি তো তোমার হয়েই
বেঁচে রইলে!” আজ আমার কথাটা না হয় আমি নিজেই একটু পরখ করে দেখি। নিজের মধ্যে, অতীতের
মধ্যে হারিয়ে যেতে পারি কিনা, আবার নাহয় রাত পোহানোর আগেই ফিরে আসবো!
জানো তো, সুকান্ত জীবনকে একদম খাড়া দুইভাবে ভাগ করে
গেছেন। তার মতামতকে মাথায় নিলে, গদ্যময় জীবনের অধিকারী আমি- তোমার মতো পদ্যময় নয়। আমার
ছেলেবেলা, বাল্যকাল তুমি জানোনা। তুমি দেখেছো আমার কৈশোরের একটি ছোট মুহূর্ত মাত্র।
আমার পরিবর্তনের সময়টা। ছোট বেলা থেকে আমি সবার কাছ থেকে একটু দূরে দূরে মানুষ। অনেকেই
ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। যেমন বুঝতে পারেনি, খুব ছোটবেলা থেকেই আমি মানুষের স্বার্থপরতার
গন্ধটাকে চিনতে পারতাম। খুব বোকার মতো মুখ করে (যদিও এমনিতেও আমি বোকা) দেখতাম, মানুষ
কেমন করে মানুষকে গ্রাস করার জন্য এলিয়ে থাকে। চোখের সামনে দেখেছিলাম আমার বাবার সম্পত্তিগুলোকে
আমাদেরই লোকজন কি নিদারূন কৌশলে আত্মসাৎ করেছে। আফসোস হয়, এর সামান্য পরিমাণ কৌশলশক্তিও
যদি তারা নিজ মেধায় সৎ উপার্জনে খাটাতো! চেয়ে চেয়ে দেখলাম, তাদেরই অনুগ্রহে আমার বাবার
বিত্তশালী স্বাচ্ছন্দ্য থেকে মহাতিক্ত দারিদ্রতায় পতন।
আমার ছেলেবেলা বা বাল্যকাল- কোনটাই তুমি জানোনা। জানার
কোন প্রয়োজনই হয়নি অবশ্য। তবে তুমি আমার কৈশোরের একটি ছোট মুহূর্ত দেখেছো- আমার সবচেয়ে
রঙচঙে মুহূর্ত; যে মুহূর্তটিতে মানুষের জীবন এক স্বর্গীয় আল্পনা হাতে হাত খুলে বসে।
পৃথিবীতে কত রকম মানুষই তো আছে- তোমার মতো কর্মী, আমার বন্ধুর মতো ভাবুক। তবে আমি নিজেকে
দর্শকের কাতারে ছাড়া কোথাও খুঁজে পাই না। ছোটবেলা থেকেই পৃথিবীকে দেখতাম, বহুভাবে দেখতাম।
তুমি জেনে আশ্চর্য হবে, আমার স্মৃতি যতদূর অতীতকে মনে করতে পারে, সেখানে আমি সেই বাল্যকালে
দেখা, শোনা মানুষগুলোর কথা, ভাব, ভঙ্গিগুলো উপলব্ধি করতে পারতাম। মানুষের দুঃখ, কষ্ট,
মান-অভিমান সবই আমি চিনতে পারতাম সেই ছোট্ট বয়সটিতে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আজকের এই
প্রায়-পৌঢ় সময়ের চেয়ে বহু ভালোভাবে পারতাম।কে জানে! বয়স মানুষের অনুভূতিগুলোকে কি ভোঁতা
করে দেয়! তোমার কি অনুভূতি আগের মতোই আছে! আছো তো?
ধুর! তোমাকে খুঁচিয়ে লাভ কি! তুমি তো সব সময়ই ঠিক।
সময়ের আন্দাজে তুমি ছিলে বুদ্ধিমান আর আমি সম্ভবত ছিলাম অকালপক্কই। তবে এর কারণও আছে।
বুনো খরগোসের কিন্তু বেশ সেয়ানা হতে হয়। ছোট বেলা থেকে আমি সবার কাছ থেকে একটু দূরে
দূরে মানুষ। খুব ছোটবেলা থেকেই আমি মানুষের স্বার্থপরতার গন্ধটাকে চিনতে পেরেছিলাম।
দেখেছিলাম মানুষ কেমন করে মানুষকে গ্রাস করার জন্য এলিয়ে থাকে। চোখের সামনে দেখেছিলাম
আমার বাবার সম্পত্তিগুলোকে আমাদেরই লোক কি নিদারূন কৌশলে আত্মসাৎ করেছে। উফ্, এর কিছু
পরিমাণ কৌশলশক্তিও যদি তারা নিজ মেধায় সৎ উপার্জনে খাটাতো! চেয়ে চেয়ে দেখলাম, তাদেরই
অনুগ্রহে আমার বাবার বিত্তশালী স্বাচ্ছন্দ্য থেকে মহাতিক্ত দারিদ্রতায় পতন। কাজী নজরুলকে
দারিদ্রতা মহান করলেও কদাচিৎ আমাদের সমাজের দরিদ্রগণ এই মহত্ত্বের আস্বাদ পান। মাঝে
মাঝে এই কবিতা চোখে পড়লে নজরুলকে তাই ঠেঙ্গাতে ইচ্ছে করে। সামান্য ক’টা টাকার জন্য
রেডিওতে ফরমায়েশি গান লিখতে লিখতে জান বের করে ফেললে, তোমার প্রতিভাকে প্রতিদিন আগুণ
জ্বেলে জ্বেলে পোড়ালে আর নিজে নিঃশেষ হয়ে গেলে সময়েরও বহু আগে। কবিতায় শোনাচ্ছো ‘দারিদ্রতা
মহান’! কি পেয়েছো তুমি দারিদ্রতা থেকে! ভালোবাসা! তোমার চাইতে বাক্যবাগীশ ভন্ড নেতাও
এখন ওটা বেশি পায়! তুমি নজরুল ভক্ত কিনা জানি না- সম্ভবত না। অত ভক্তি-টক্তির সময় কোথায়
তোমার! তারপরও ক্ষেপো না আবার। আমি নিজে নজরুলের উপর মহা ক্ষ্যাপা ক্ষেপে আছি। আমার
স্যার চেয়েছিলেন ওকে দিয়ে একটা লাইন অন্তত লেখাতে কিন্তু আমি হলে, ওকে দিয়ে আবার সবকিছু
শুরু থেকে লেখাতাম। ধ্যাত, কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে গেছি। তবে তোমাকে এসব অবান্তর
কথা লিখতেও কেন যেন ভালো লাগছে। খুব ভালো লাগছে। বলা হয়নি তো তোমাকে কোনদিন! সব জমে
পাথর হয়ে আছে! আসলে কাউকেই বলা হয়নি।
যেটা বলছিলাম – এই নজরুল-স্বীকৃত মহাপুরুষদের জীবনযাত্রা যেভাবে এগোয়
সেখানে অবধারিতভাবে আসে- অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তায় পারিবারিক সম্পর্কের অধঃপতন। আমিই বা
সাধারণ মানুষ হতে যাবো কেন! ‘দারিদ্রের কষাঘাত’ বলে যে শব্দগুচ্ছ খুব গুছিয়ে টুছিয়ে
কাব্য করা হয়, তার দৌলতে- মানুষ যে মানুষের সঙ্গী হতে পারে, এই বিশ্বাস আমার বিচূর্ণ
হয়ে গেলো বাল্যকালেই। মানুষ মানুষের কথা বুঝতে পারবে, তাকে গ্রহণ করতে পারবে, একজন
আরেকজনের সমব্যথী হবে, একজন আরেকজনের অনুভূতিকে উপলব্ধি করবে- এই ধারণাটাকে কৈশোরে
এসেও মনে হতো- বইয়ের ভাষা, দিবাস্বপ্ন, অসম্ভব কল্পনা, বাংলা সিনেমা। সুর আছে বাস্তবতা
নেই। সেই বাল্যকালেই দারিদ্রতার মহত্ত্বে সাক্ষী হতে হলো, সেইসব ঘটনার,
যা একজন সন্তানের জন্য পৃথিবীর সবচাইতে করুণতম দৃশ্যগুলোর একটি- সন্তানদের চূড়ান্ত
ভালোবাসা সত্ত্বেও তাদের পরিপূর্ণ স্বাচ্ছন্দ্য প্রদানের অক্ষমতা, ব্যর্থতার গ্লাণি
নিয়ে বাবা-মায়ের চাপা-কান্না। তোমাকে যেমন আমি ভুলতে পারি না, এগুলোও ভুলতে পারি না।
ভুলতে চাই, সবই ভুলতে চাই। এই সব নিচু স্মৃতিগুলো ভেতরে ভেতরে নিজেকে ছোট করে দেয়,
আমার ভেতরের আমিটাকে কুঁকড়ে দেয়, নিচু করে দেয়। তোমার সাথে কথা বলতে যেমন ভালো লাগে,
আর এগুলো নিয়ে কথা বললে এখনও বুক ভেঙ্গে আসে। তুমি এই অনুভূতি বুঝবে না- হ্যা, বুঝেশুনেই
বলছি, তুমি এই অনুভূতি কোনভাবেই বুঝতে পারবে না। কারণ আমি জানি, তোমার ইতিহাস ঠিক এর
উল্টো। তোমার জন্মের আগেই অস্বাচ্ছন্দ্য থেকে নিজ শ্রমে ধীরে ধীরে স্বাচ্ছন্দ্য পেয়েছে
তোমার পরিবার।
খুব মজার একটা ব্যাপার আছে জানো। তুমি হয়তো জানো না-
তোমার পরিবার আর আমার পরিবারের ভাঙ্গা গড়ার এই খেলাটিতে আমরা কিন্তু সবসময় পাশাপাশিই
ছিলাম। একই এলাকায়, কাছাকাছি বাসায়। ছোটবেলায় টো টো করে ঘোরাটা আমার অভ্যাসের একটি
ছিলো। ঐযে বললাম, কিছুটা গাঁটছাড়া ছিলো আমার জীবন। তাছাড়া সেসময়ের বাবা-মায়েরা তোমার
আমার মতো এত হিসেবি ছিলো না মোটেও। কতবার আমি তোমাদের বাড়ির আশে পাশেই হেঁটেছি, ঘুরেছি।
হয়তো তোমাকে দেখেছিও তোমার ছোট্ট বেলাটিতে। কে জানতো! মনের একটা সুতো কোনদিন তোমার
সাথে এভাবে বাঁধা পড়ে থাকবে।
তোমার বাবা তার পরিবারকে গুছিয়েছেন, ভালোবাসা দিয়ে
তাদের জমাটবদ্ধ করেছেন। হিলিয়াম আর ইউরেনিয়ামের মধ্যে যেমন একটা আকাশ যোজন পার্থক্য
থাকে জানো তো! তোমার আর আমার জন্মের মধ্যেই সে পার্থক্য সূচিত হয়ে গেছে আসলে।
আমি আমার পরিবারকে ভালবাসি। আমাকে তারা কোনদিনও বুঝতে
পারেনি। কিন্তু আমি তাদের খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারতাম, এখনো পারি। স্রষ্টা এই নির্বোধ,
রোমান্টিক ফুল, ছন্নছাড়া আমিকে আর কিছু দিক না দিক, এই ভালবাসা নামের বদহজমিটাকে ঢেলে
দিতে কোন কার্পণ্য করেননি। আমার বয়স তখন মাত্র সাত কি আট। কিন্তু এখনো মাঝে মাঝে বিস্মিত
হয়ে ভাবি, সে সময়ই মানুষের সম্পর্কগুলোর, তাদের আচরণের, তার পেছনের উদ্দেশ্যগুলোর অনেক
সূক্ষ্ম, বিমূর্ত, অদেখা, অপ্রকাশ্য ব্যাপারগুলোও কিভাবে বুঝতে পারতাম! কি জানি! হয়তো এটা সবার বেলায়ই হয়!
সে সময়, বাবা-মায়ের এই অক্ষমতার দংশনে আহত বিষণ্ন মুখ
দেখতে একদমই ভালো লাগতো না। অনেকটা এই কারণে এবং অনেকটা তাদের এই গ্লাণির বোঝা হালকা
করার জন্যই, আমি থাকতাম আমার খালার বাসায়। যদিও আমার পরিবার, তার পরিবার সবাই ভাবতো-
একটু ভালো খেতে পারবো বলে সেখানে পড়ে থাকি। কি নিদারুণ ভুল বোঝাবুঝি! তোমাকে লিখতে
গিয়েও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে, জানো! এই ভুল
বোঝাবুঝিটা কিন্তু আমার নিত্যসঙ্গী হয়ে গিয়েছে তার পর থেকে। হয়তো আমি আমাকে বোঝাতে
পারি না। হয়তো যারা অনেক কথা বলে, অনেক বেশি আহা-উহু করতে পারে – আমারও উচিৎ ছিলো তাদের মতো হওয়া। পারিনি। এখন আর পারতেও
চাই না। এই অনুভূতিটাও কাউকে বলা হয়নি। এত কথা কি করে ধরে রাখি বলো? একটা জীবনের সব
কথা জমে আছে।
বলতে গেলে খালার বাসায়ই বড় হয়েছি। সেখানে খালার ভালবাসা
পেয়েছি- আবার খালুর ঘৃণা, সুতীব্র অবহেলাও পেয়েছি। খালার ভালবাসা নিষ্কলুষ হোক বা না
হোক, তার একটা সীমা তো থাকেই। তার ভালবাসার উত্তাল সমুদ্রকেও যেমন দেখেছি, তেমনি দেখেছি
তার তটভূমিও। বাবা মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকার ফল যে খুব বেশি ভালো হয়েছে তা কিন্তু
নয়। তাদের সাথে ধীরে ধীরে দূরত্বই বেড়েছে শুধু। ঐ যে বললাম, জীবনের শুরুতেই তারা ধরে
নিয়েছে- আমি একটু ভালো খাবার জন্য সেখানে যাই। আর সেই শৈশবে এটি আমার মাঝে তৈরি করে
দেয় এক শক্ত অভিমানের প্রাচীর। কেন এরা আমাকে বুঝতে পারলো না!
এই বয়সেই অনেকটা জেনে গেলাম সবাই তার নিজের মতো করে
চিন্তা করে। প্রত্যেকটা মানুষের নিজের তৈরী করা ভিন্ন ভিন্ন রঙ্গের একটা করে ঠুলি আছে,
যা সে চোখের উপর রাগিয়ে রাখে, আর সমগ্র পৃথিবী, মানুষ, সমাজ, ধর্ম, শিক্ষা, জীবনকে
দেশে সেই ঠুলির রঙ্গে। এর আবার একটা গালভরা নামও আছে- জীবনদর্শন। যদিও শব্দটা দরিদ্র
ব্যক্তিদের বেলায় অপ্রযোজ্য এবং তারা সারা জীবনে এ শব্দটা শোনেও না, মানেও জানে না।
কিন্তু এই জীবনদর্শন সবারই থাকে এবং বেশিরভাগ মানুষকে তাদের সেই দার্শনিক আইডিয়া থেকে
সরানো সম্ভব না, ক্ষেত্রবিশেষে অসম্ভব।
কিন্তু এই জীবনদর্শনের পার্থক্য কিভাবে মানুষের সম্পর্কের
মধ্যে, মানুষের হৃদয় থেকে হৃদয়ে দূরত্ব সৃষ্টি করে তার একটা নমুনা দিচ্ছি আমার শৈশবেরই
একটা ঘটনা তোমাকে বলে। আমার বয়স তখন দশ কি এগারো। অর্থনৈতিক দুরাবস্থার চূড়ান্ত রূপ
চলছে আমাদের পরিবারে। ভালো কোন রান্না করা পরিবারে একটা মহোৎসব। একদিন সেই উৎসবটাই
শুরু হলো। যেভাবেই হোক বাবা একটু ভালো খাবারের
বন্দোবস্ত করলেন। খালার বাসা থেকে অন্তত দিনে
একবার তো আসতামই বাসায়। একই শহরে যেহেতু আছি।
সেদিন বাসায় একটু ভালো রান্নার উৎসবের আনন্দে
শরীক হতে চাইলাম, চাইলাম সবার সাথে আনন্দটা ভাগ করে নিতে। হাসিমুখ আমাদের ঘরে তো থাকেই
না। বিষাদে শরীক হতে যে বুকের পাটা লাগে- তা নেই বলেই তো খালার বাসায় পালিয়েছি। তাই
সেদিন দুপুরে খাওয়ার সময় বাসায় থেকে গেলাম। যথারীতি ভাই-বোনদের সাথে কিছুটা হুটোপুটি,
কিছুটা প্রতিযোগীতা নিয়ে খাচ্ছিলাম। ঠিক এসময়, আমার মা আমাকে অভিযোগ করে বসলেন, ভালো
ভালো খাবার প্রতিদিন খাওয়া সত্ত্বেও, আজ এখানে
ভালো খাবারের লোভে নাকি আমি বসে আছি। তার উপর তখনো রাগ করিনি, এখনো করিনা। তবে ভুলতে
পারিনি, কারণ পৃথিবীর নির্মম শিক্ষাগুলোর একটা ছিলো এটা; মনে তো রাখতেই হবে। মানুষ
যে মানুষকে বুঝতে পারবেনা, এই মৌলিক ধারণার প্রথম ছবকটা পেলাম সেদিন। আর এরকম হাজারো
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্মৃতি দিয়েই তো শিক্ষা তৈরী হয়, স্বাতন্ত্র্য জীবনদর্শন পূর্ণতা পায়।
তারা আমাকে বুঝতে পারেনি। সেই বয়সেই যে আমার
মনের আনন্দের স্বরূপ আমাদের সম্পর্কগুলোর মধ্যে ছিলো, সম্পর্কগুলোর মধ্যে সামান্য আনন্দও
ভাগ করে নেয়াটা যে আমার উদ্দেশ্য ছিলো, তারা তা বুঝতে পারেনি।
অনেকটা বড় হওয়ার পরে অবশ্য ধারণাটা কিছুটা পাল্টেছে।
এখন আমি জানি, কেউ যদি কাউকে বুঝতে চায়, তাহলে বুঝতে পারে। মানুষের মনের অসীম ক্ষমতা
আছে, আরেকটা মনকে বুঝতে পারার। তবে তার জন্য চাই হৃদয়ের একই ফ্রিকোয়েন্সিতে যোগাযোগ,
জানার চেষ্টা। পূর্বধারণামুক্ত হয়ে ঐকান্তিক একাত্মতা। এখন আমি জানি, আমাকে কেউ বুঝতে
পারেনি, কারণ আসলে তেমন করে আমাকে কেউ বুঝতে চায়নি। একটা সময় এই ভুলে ছিলাম যে, তুমি
সেই চেষ্টা করেছো। এখন আর নিশ্চিত নই- আমিও বড় হয়ে গেছি, তুমি তো বড় হয়েছোই।
শুনে আশ্চর্য হবে, আমার স্মৃতিভান্ডার যতদূর যেতে পারে,
সেখানে স্বেচ্ছায় আমার মা আমাকে স্পর্শ করেছেন বা আমি আমার মাকে স্পর্শ করেছি এই দৃশ্যটি
নেই। একদম নিরঙ্কুশ, স্বার্থহীন ভালবাসা, মমতা, স্নেহ- যা দিয়ে একটা মানুষের হৃদয়টা
পূর্ণ হয়, সেটা আমার কোন কালেই ছিলো না। আর একারণে হয়তো, স্বাভাবিক মানুষ যেমন হয়,
সেরকমটা আমি হতে পারিনি। ভালবাসায় দরিদ্র হয়ে থাকতে হয়েছে আজীবন। আর স্বার্থপরতার এই
যুগে এই দরিদ্রের প্রাচুর্য্য পাবার সম্ভাবনার আশা তো স্পর্ধার সামিল!
তবে আমার এই কাঙ্গালপনাটাকে উপলব্ধি করতে পেরেছি অনেক
পরে, তোমার সাথে দেখা হওয়ার পরে। আমার এই অজানা দারিদ্র আমার অতি চেনা-জানা দারিদ্রের
সাথে যুক্তি করে, আমাকে হীনমন্য করে তুলেছে। নিজেকে প্রকাশ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি
সে-সময়ই। তোমার মনে আছে, সেসময় কেমন জবুথবু হয়ে থাকতাম আমি সবসময়? কি রকম উদ্ভট সব
আচরণ করতাম! সবার কাছ থেকে আমি কেমন লুকিয়ে থাকতে চাইতাম। কারো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা
বলতে পারতাম না। নিজেকে সবসময় কেমন যেন চোর চোর লাগতো। তোমাদের ভাষায়, যাকে বলে “ক্ষেত”-
এরকম একটা সোঁদা মাটি নিয়ে তোমাদের বাড়ির সবাই যে হাসাহাসি করতো তা আমি জানতাম (মনে
মনে ফুঁসে উঠো না, মন্তব্যটা আমার হীনমন্যতাজনিত বিভ্রান্তিও হতে পারে, স্বীকার করছি)।
কিন্তু সেই অবজ্ঞা, অবহেলা, হাসির পাত্র হওয়ার ভাগ্যটাকেই যে আমার একেবারে সাধারণ,
নৈমিত্তিক বলে মনে হতো। সেরকম করে কষ্টও পেতাম না, বিশ্বাস করো। বরঞ্চ মাঝে মাঝে নিজেও
আনন্দ পেতাম, এটাই যে চিরাচরিত নিয়তি, এরকমই যে হওয়ার কথা। সেইসাথে সারাদিন হাসি-ঠাট্টা,
আমোদ-প্রমোদ, সামাজিকতার আড়ালে কিভাবে নিজেকে ঢেকে রাখতে হয়, সেই শিক্ষাটাও সেসময় পেয়ে
যাই একেবারে গতানুগতিক ধারায়। আমার আমিকে, আমার হৃদয়কে, আমার দর্শনকে, আমার চিন্তা-চেতনা,
সুখ-সমৃদ্ধি, দুঃখকে স্পর্শ করার লোকের অভাব আমাকে চিরজীবন চিরঅনাথেই পরিণত করে রেখেছিলো।
আর আমিও সেগুলোকে ঝিনুকের খোলসে ঢেকে রাখার মতো করে বাঁচিয়ে রাখার কৌশল শিখে ফেললাম।
সেখানে হঠাৎ তুমি এলে- সন্ধ্যাতারা! ছন্দময় অনুপ্রবেশ।
দেখলাম, তুমি ছোটকেও দেখতে পাও, তোমার সহানুভূতি আছে, আমার মতো অনাথকেও তুমি সম্মান
দিতে জানো, আমার দুর্বলতাগুলোকে লুকিয়ে রাখার ভদ্রতাটুকু রক্ষা করতে পারো। এই একজন
মানুষ যাকে দেখলাম আমাকে নিয়ে হাসছে না, আমার কথায় হাসছে। খরতাপে পুড়ে যাওয়া মাঠ দেখেছো?
ফাটা ফাটা, শুস্ক- দিগন্তবিস্তৃত রুক্ষতা। পানি তারা চেনে না, তাই প্রকৃতির সাথে তার
কাঠিন্যটাকে কিরকম মিলিয়ে মিশিয়ে দিয়েছে অবলীলায়। তার এই শুস্কতা যেন কতই না স্বাভাবিক!
কিন্তু যেই বৃষ্টির পানি পড়ে, গলে কাদা। একটু বাড়াবাড়ি রকমেরই কাদা হয় তখন, সমস্ত পানিকেই
নিজের রঙ্গে রঙ্গিন করে, পা ফেলা যায় না- আটকে যায়।
আমার জীবনে, তুমিই প্রথম এবং একমাত্র, যে আমার বোকামিগুলোকে
স্নেহ দিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছিলে। তোমার মনে আছে কিনা জানিনা, তোমার সামনে কেউ আমাকে সামান্য
অবহেলা করলে বা আমি অবহেলা মনে করবো, এরকম কোন কারণ ঘটলেও অসন্তুষ্ট হতে। জানিনা আমি,
ওগুলো হয়তো তোমার কাছে সাধারণ ভদ্রতা ছিলো কিন্তু আমার কাছে তা ছিলো অমূল্য। বালিও
তো অমূল্য হয়, যাদের কাছে তা নেই- তাদের কাছে। এই প্রথম আমি মানুষের সাথে মানুষের সহানুভূতি,
মানুষের হৃদয়ে মানুষের স্পর্শের অনুভূতি পেলাম। জানতে পেলাম, মানুষ মানুষের মনকে গুরুত্ব
দিতে পারে- বিশেষ করে আমার মতো একজনের মনকে! এক অজানা জগৎ আমার সামনে উন্মোচিত হলো।
আমি হারিয়ে ফেলতে থাকলাম, আমার এতদিন ধরে চিনে আসা আমিকে। এই প্রথম মনে হলো, আমার চেনা-জানার
বাইরের, মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের চুক্তি, ব্যবসায়িক সখ্যতার বাইরেও আরো কিছু
আছে। আমার হৃদয়ের পোড়া মাঠ বৃষ্টিতে ভিজে গেলো। তোমার দেশে পানির অভাব ছিলো না, কিন্তু
আমার মরুভূমিতে যে তা ভীষণ দুস্প্রাপ্য, অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিত উপহার- আর তাই তার
মূল্যও যে অসীম। এই প্রথম আমি কারো কাছে কথা বলতে পারলাম, নিজেকে একটু হলেও প্রকাশ
করতে পারলাম- এক নতুন, আকস্মিক, অযাচিত অভিজ্ঞতায় উন্মত্ত হয়ে উঠলো মন- আরো বেশি করে
নিজেকে প্রকাশ করতে চাইলো। তুমি আমার জীবনে জীবনানন্দের কবিতার মতো হয়ে এলে- স্নিগ্ধ, প্রশান্ত, নির্জন, নিজের গভীরতম মনের মতো-
কান্তারের
পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে
সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,
বলিল, তোমারে চাই: বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ
খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি— কুয়াশার পাখ্নায়—
সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে-আলোক
জোনাকির দেহ হতে— খুঁজেছি তোমাকে সেইখানে—
ধূসর পেঁচার মতো ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে
ধানসিড়ি বেয়ে-বেয়ে
সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে
তোমারে খুঁজেছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে।
সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,
বলিল, তোমারে চাই: বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ
খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি— কুয়াশার পাখ্নায়—
সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে-আলোক
জোনাকির দেহ হতে— খুঁজেছি তোমাকে সেইখানে—
ধূসর পেঁচার মতো ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে
ধানসিড়ি বেয়ে-বেয়ে
সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে
তোমারে খুঁজেছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে।
মনে করে দেখো, আমি যে বইগুলো ভালবাসতাম, তোমাকে পড়তে
বলতাম। তুমি যে গানগুলো ভালবাসতে সেগুলো আমি শুনতাম, তোমার পছন্দের বইগুলো পড়তাম। তুমি
আমার একটা জগৎকে উদ্ভাসিত করেছো, আমিও তোমার জগৎকে স্পর্শ করতে চাইতাম। এটা কি প্রেম,
নাকি ভালবাসা, নাকি আর কোন সম্পর্কের সংজ্ঞা দিয়ে বাঁধা যাবে- নিজেকে সেই প্রশ্ন করার
বোধবুদ্ধি ততক্ষণে উধাও।
এই প্রথম আমি বুঝতে শিখলাম, আমাকে অন্য সবাই এতদিন
অবহেলা করেছে- যা করা তাদের উচিৎ হয়নি। তুমি উচিৎ-অনুচিতের এই প্রশ্নটাকে প্রথম আমার
মনে জাগিয়ে দিলে। এই প্রথম তুমি আমাকে কষ্ট পাওয়া শেখালে। মন বিদ্রোহী হলো- এতদিন ধরে
মেনে আসা নিয়তির মুখে। ইচ্ছে হলো, এবার ভাগ্যের পায়ে নত হয়ে না থেকে উঠে দাড়াবো- আমার
ভাগ্যরেখা এখন আমিই অঙ্কন করবো। আমি অন্য মানুষ
হতে শুরু করলাম। তোমার অসামান্য একটা স্পর্শ- আমার ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা সত্যিকারের আমিটাকে
জাগিয়ে তুললো। পুর্নজন্ম হলো আমার। পৃথিবীতে আমার আরেকজন জন্মদাত্রীর পরিচয় পেলাম।
আমার এই শুকনো কটকটে জীবনে তোমার এই আর্দ্র স্পর্শ
একটা নতুন গভীর দাগ তৈরী করে গেলো। ভেজা মাটির দাগ শুকোলে তা কিন্তু থেকেই যায়, তাই
না? তোমার সহানুভূতি, শ্রদ্ধা আর বহু ব্যাপারে মতের মিল, আমার হৃদয়কে উদ্বেলিত করলো।
এই প্রথম একজন মানুষকে দেখলাম যে আমার কথা শোনে, আমাকে কথা বলার জন্য ব্যাকুল নয়। এই
প্রথম একজন মানুষ আমার মতো নির্বোধের কাছেও জানতে চায়। আমার দু’একটা পাগলামীকে প্রশ্রয়ও
দেয়। এমন একজন মানুষ এই প্রথম দেখলাম- আমি কে, কেমন- তার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ যে, আমি একটা মানুষ; আমার
মনেও ক্রিয়া-বিক্রিয়া হতে পারে, সেটা লক্ষ করতে জানে। তুমি হয়তো জানো না, আমি কেবল
তোমাকে নয়, তোমার পুরো পরিবারকে আমার প্রতি তাদের আচরণের জন্য শ্রদ্ধা করি; সম্ভবত
মৃত্যু পর্যন্তই করবো। আজ পর্যন্ত তারা এমন কিছুই করতে পারেনি, আমার অন্তর থেকে তাদের
প্রতি ভালোবাসা কোনভাবে এতটুকু কমে যাবে!
তোমার সহানুভূতি, শ্রদ্ধা, আমাদের অপরিপক্ক চিন্তা-চেতনার
সাদৃশ্য- আমার হৃদয়ের কতটা গভীরতায় অনুপ্রবেশ করলো তা কি ভাবতে পারছো এখন? জান তো, শান্ত দিঘীর পানিতে ছোট্ট একটা ঢিলও দেখার
মতো ঢেউ তোলে। মনের এতটা নরম জায়গায় এর আগে আর কারও স্পর্শ তো পড়েনি, তাই এবার এক চিরজীবি
আন্দোলন শুরু হলো এবং চলতেই থাকলো.......................। খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু যারা তোমার
সম্বন্ধে আমার কাছ থেকে জানে। তারা বার বার প্রশ্ন করেছে, হিসাব মেলাতে পারেনি- কেন
আমি তোমাকে মনে রাখি। কোন মানুষ তো এটা করে না! আমি নিজেও মাঝে মাঝে ধন্দে পরে থাকি।
সত্যিই তো!
কিন্তু আর কেউ না জানলেও আমি তো জানি- ভালোবাসা নয়,
প্রেম নয়, বিয়ে নয়, অন্য কিছু নয়; স্রেফ আমার মনকে তো আর কেউ নিঃস্বার্থে কোনদিন স্পর্শ
করেনি। পৃথিবীতে একমাত্র তুমিই করেছো। খুব ছোট ছোট কিছু আচরণ দিয়ে; খুব সামান্য একটু
গুরুত্ব দিয়ে- কিন্তু সেটাই যে আমার কাছে বিশাল।
সম্পদশালীকে যখন কেউ সম্মান করে, সেটা আর সম্মান থাকে না সেটা হয় লোকদেখানে স্বার্থবাদী
ভড়ং, অথবা সেটা তার প্রাপ্য হয়ে যায়। কিন্তু দরিদ্রকে যখন কেউ সম্মান করে- তখন সেই
দরিদ্রের কাছে তার মূল্য কতটুকু তা কি তুমি উপলব্ধি করতে পারবে! জানি না। তবে বোধহয়
পারবে না। তুমি কোনদিনই দরিদ্র ছিলে না। যে পরিবার আমার মত বাইরের এক বেচারাকে এতটা
দিয়েছে, তারা তোমাকে দরিদ্র রাখবে না। তুমি আশির্বাদপ্রাপ্ত।
তোমার সেই সময়ের সেই স্পর্শটুকু এখনো আমাকে মনে করিয়ে
দেয়, আমি মানুষ। পাথর হয়ে যাওয়া মনে, এখনো বুঝিয়ে দেয়- আমার অনুভূতি আছে। এইটুকুও কি
তুমি ত্যাগ করতে বলো? এতটুকু মানুষও কি আমাকে
থাকতে দেবে না। পৃথিবী চেয়েছে যেন আমি মানুষ না থাকি, তুমি একবার কেবল বলো- তুমিও তাই-ই
চাও; আমি আমার মনুষ্যত্বকে ত্যাগ করছি। কিন্তু তা যদি না বলতে পারো, তবে তোমাকে থাকতে
দাও আমার সেই অনুভূতির স্মৃতিটুকুতে। খুঁজে না পাওয়া ফুলের সুবাসের মতো থাকো, ধরতে
না পারা সন্ধ্যাতারার মতো থাকো- কিন্তু থাকো। যতবার আসবে একটু বিশ্রাম, একটু স্নিগ্ধতাকে
বয়ে নিয়ে এসো।
তোমার আরও একটা ব্যাপার আমি কোনদিনই ভুলতে পারি না।
সেটা তোমার মনের অনুসন্ধিৎসু মন, জ্ঞানের প্রতি তোমার কৌতুহল।সেই ছোটবেলা থেকেই তুমি
জানতে চাইতে, কোন কিছু বুঝতে পারতে, ধারণ করতে পারতে হৃদয়ের গভীর থেকে। পৃথিবীকে জানতে
চাইতে, ধর্মকে জানতে চাইতে, পৃথিবীর রহস্যগুলো তোমাকে ভাবাতো। তুমিই ছিলে আমার দেখা
প্রথম মেয়ে- যার তোমার বয়সে বই পড়ায় অভ্যাস ছিলো। তুমিই আমার দেখা প্রথম মানুষটি ছিলে,
যে আমার মতোই কোনকিছু মুখস্থ না করে আত্মস্থ করতে চাইতে। তুমিই সেই মেয়ে যে আমার কথায়
সেই বয়সেই মেডিটেশন করার মতো মনোযোগ, আগ্রহ আর সাহস সঞ্চয় করতে পেরেছিলে। হয়তো বলবে,
এগুলো আমার ভ্রান্ত দেখা, নিজের মনে বানানো বিচার কিন্তু এরকম ভ্রান্ত দর্শন আরো হাজারটা
আমি তোমাকে বলতে পারি। হয়তো বলবে এতসব কারণের কোনটাই আসল কারণ নয়, এই কারণের ঝর্নাধারার
উৎপত্তি তোমার প্রতি আমার স্নেহের হিমালয় থেকে। বলতে পারো- আপত্তি করনো না। তবে আমার
কাছে তা সত্য, ধ্রুবতারার মতো সত্য। হয়তো কোনদিন ধরা যায় না – কিন্তু পথ দেখায় ঠিকই। এতটা জীবনই যখন সংশোধন করতে
আসলে না, আজ আর তার দরকারটাই বা কি!
আমি নিজে একটা চিরকালীন অপদার্থ, অকালকুষ্মান্ড, আমাদের
সমাজের ভাবুক সম্প্রদায় যে রকম হয় আর কি। আমরা ভেবে ভেবেই হিমালয় পাড়ি দিই, চাঁদে পদচিহ্ন
রাখি, পৃথিবী ভ্রমণ করে আসি। নিজের এই অকুন্ঠ সামর্থ্যের জোরে ধারণা হলো, তুমিও হয়তো
এরকম ড্রিমিং সুপার উইম্যান জাতের একটা কিছু। আর তা থেকে এই আহম্মক মনের একটা ভুল ধারণা
হয়েছিলো যে, তুমিও হয়তো সেরকম একটা কিছু- হয়তো তোমার সাথে আমার কোথাও মিল আছে। নিতান্তই
নির্বোধের চিন্তা- একদই ভুল চিন্তা। তবে এটা এমন একটা ভুল যা আমার মনকে শান্তি দিয়েছে,
অন্য হাজারো শুদ্ধতা তো সেটা দিতে পারলো না। তাই এই এই ভুলটাকেই আমি ভালোবাসি, শ্রদ্ধা
করি। কিছুই করার নেই এর অত্যাচার সহ্য করা ছাড়া।
তুমি তো ডাক্তার। কাজেই অন্তত তুমি তো ভালভাবেই জানো,
মানুষের শরীরের কোন ডিসচার্জ যদি বন্ধ থাকে, কি রকম প্রভাব তার শরীরে ও মনে পড়ে। আমার
এই বছরের পর বছর আটকে থাকা কথা, মৌন কান্না, গ্লাণী ও ব্যর্থতার স্বীকারোক্তি একটু
ছাড়া পাবার আশায় ছটফট করছে। আমাকে হুমকি-ধামকিও দিচ্ছে- আরো কিছুদিন যদি বেঁচে থাকতে
চাও- শিঘ্রী আমাকে মুক্তি দাও। তাই-ই দিচ্ছি আসলে! আমার নিজেকে, আমার স্মৃতিকে, আমার
ইচ্ছাকে, তোমার প্রশ্নকে সবকিছুকেই মুক্তি দিচ্ছি এই লেখা দিয়ে। ওভারফ্লোয়িং ডিসচার্জ।
জীবনকে পূর্ণ করার জন্য বেঁচে থাকতে চাইছি, তা নয়- কর্মকে পূর্ণ করার জন্য বেঁচে থাকতে
হবে। এমনিতেই যথেষ্ঠ কান্ডজ্ঞানহীন আমি, আর দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে পাপবৃদ্ধি করতে চাই
না। শুধু তোমাকে বেছে নেবার কারণ- এর উৎস, উৎপত্তিস্থল, জন্মদাত্রী- তুমি।
কারণগুলো বললাম, কিন্তু জানলে কি? হয়তো এ কথাগুলোও
হাওয়ায় ভেসে যাবে; ঔ যে আগেই বলেছি সে নিজেই তার গন্তব্য খূঁজে নেবে। হয়তো অন্য কোন
সময়ে, অন্য কোন স্থানে, অন্য কোন ডাইমেনশনে, অন্য কোন পৃথিবীতে। আজ তো আর মেঘদূতের
আমল নেই, যে সেগুলো সে তোমার কাছে বয়ে নিয়ে যাবে আমার জন্য। এ হচ্ছে ঘোর কলি। কেউ কারো
কথা শোনে না। আর আমি এ কলিযুগের একটা বেমানান স্যাম্পল। বেমানান বলছি একারণে যে এই
ইমেইলের যুগে, ষোল বছর ধরে কাউকে দিনে কয়েকবার করে চিঠি লেখার হাস্যকর বিলাসিতা এই
আধুনিক সময়ের হিসেবি মানুষদের কাছে মানানসই হবে কোন আক্কেলে! কিন্তু তবুও লিখছি, আমার
যে আর কিছু করার নেই! আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ।
তবে কথাগুলো তুমি জানতে পারলেও যে অন্তরে খুব প্রশান্তি
নেমে আসবে – ব্যাপারটা এমনও নয়। কারণটা
কি জানো? মানুষ যত বড় হয় তার হৃদয়বৃত্তিও ততই ক্ষুদ্র হতে থাকে। যদি তুমিও বড় হয়ে যাও,
তবে আমার সমগ্র অনুভূতিকে উপেক্ষা করার মতো নিষ্ঠুরতা হয়তো তোমার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে।
এই ভয়টাও তো অমূলক নয়, নাকি? কিন্তু প্রশান্তিটা
হচ্ছে, তোমার কাছে আমার বিশেষ কিছু চাওয়ার নেই। স্বামী বিবেকানন্দের একটা কথাকে খুব
করে ভাবি আমি।
“All misery and pain come from
attachment”
আর তথাগত, কৃষ্ণ বলে গেছেন কিভাবে সে দুর্দশা থেকে
মুক্ত থেকেও ভালোবাসা যায়, তারস্বরে বলে গেলেন- প্রত্যাশামুক্ত হও। তবে প্রত্যাশামুক্তি
তত্ত্বে আসলে কি বলা হয়েছে, তা নিয়ে আমার যথেষ্ঠ প্রশ্ন আছে। কেন বলছি এ কথা? ইচ্ছা,
প্রত্যাশা, কামনা (কামবিহীন) এগুলো স্বয়ং স্রষ্টার বৈশিষ্ট্য, যা আল্লাহ মানুষের মধ্যে
তার রূহ ফুঁকে দেয়ার সাথে সাথে প্রদান করেছেন। এগুলো মানুষের মনুষ্যত্বের বৈশিষ্ট্য,
মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির নিদর্শন। কিন্তু এগুলোই যখন পাশবিক ইচ্ছাপূরণ আর কামনা-চরিতার্থের
হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়, তখন তা বরঞ্চ ছুরির ধারালো উল্টোপিঠ হয়ে গলায় বসে। আমার
মনে হয়, পবিত্র ইচ্ছা ও প্রত্যাশা বলেও একটা কিছু আছে, যাতে থাকে মঙ্গল-কামনা ও ত্যাগ।
আর তার আকার যত বড় হতে থাকে, ভালবাসার ব্যপ্তি যত বৃহৎ হতে থাকে তার মূল্যও হতে থাকে
তত বেশি। এমনকি কেউ যদি নিজেকে, সমগ্র সৃষ্টির প্রতি প্রবাহিত স্রষ্টার উৎসারিত ভালোবাসার
স্রোতে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করতে পারে, তাহলে তার ভালোবাসা-বোধ হবে সর্বোচ্চ। তার
সর্বপ্রেম সম্পন্ন হবে। তাহলে প্রশ্ন তো জাগবেই যে, প্রত্যাশামুক্তিই মহত্ত্বের লক্ষণ-
নাকি প্রত্যাশার ব্যাপ্তি বৃদ্ধি? কোন একজন মেয়েকে শরীরের উত্তেজনায় ভালবাসাটাও এক
ধরণের ভালবাসা, ক্ষণস্থায়ী ভালবাসা, কেউ কেউ হয়তো পাশবিক ভালবাসাও বলতে পারেন। তাকে
আরো উন্নত কোন কারণে ভালবাসায় ব্যাপ্তিটা আরেকটু বাড়ে। নিজের স্বার্থচিন্তা সম্পূর্ণরূপে
বিসর্জন দিয়ে, উভয়ের জীবনকে মহত্তর কোন কাজে নিবেদন করা, ব্যয় করার প্রচেষ্টায়- একই
চিন্তা, দর্শন ও মহত্তর উদ্দেশ্য সার্থক করার প্রচেষ্টায় যে ভালবাসার সৃষ্টি হয়, তা
আরো উন্নত নিঃসন্দেহে। কারো সমস্ত নারীজাতির প্রতি ভালবাসা প্রকাশটা নিশ্চয়ই দুর্বলতা
নয়, ওটাও বরং মহত্ত্ব। আর এরপর সমস্ত জীবকে, সমস্ত মানবজাতিকে এবং তার স্রষ্টাকে ভালবাসার
আকাঙ্ক্ষা আর সেই সাথে স্রষ্টার ভালবাসা পাবার প্রত্যাশার চাইতে বড় কিছু আর কি থাকতে
পারে? যে মহান দাতা, পরম প্রেমময়, করুনার আধার আল্লাহকে ভালবাসতে পারে না, সে আর অন্যকে
ভালবাসবে কিভাবে? স্রষ্টার ইচ্ছায় নিজের ইচ্ছার
সমর্পণে স্বাধীনতার বিলুপ্তি ঘটে না, বরং সমগ্র জগতের প্রতি ভালবাসা, তাদের সুখি দেখার
বাসনা, তাদের শান্তির প্রত্যাশায়, তার পূর্ণ ব্যাপ্তি লাভ করে। এই বিশাল মহৎ প্রত্যাশাই
আমাদের মুক্তির পথ। তাঁরা সম্ভবত প্রত্যাশা বলতে হীন-প্রত্যাশাটুকুকেই বুঝিয়েছেন।
দর্শন ফেঁদে বসায় আমার জুড়ি নেই। তোমার সংজ্ঞায়িত
“প্রেমপত্রে” এবার দর্শনতত্ত্ব নিয়ে কি রকম দুর্ধর্ষ-রকম খবরদারি শুরু করেছি! এদিকে
তুমি কেমন আছো, সেটাই জিজ্ঞাসা করা হয়নি। তবে তা জিজ্ঞাসা করার দরকারও আসলে নেই। প্রথম
কারণ তার উত্তর কখনো আমার কাছে আসবে না। আর দ্বিতীয় কারণ, আমি জানি তুমি ভালো আছো।
খারাপ থাকার মতো কিছু তুমি করোনি, কাজেই ভালো থাকা ছাড়া তোমার আর কোন উপায়ই নেই- নিরুপায়।
খারাপ থাকার প্রশ্নটা আমার মতো বাউন্ডুলে, ছন্নছাড়া, মতিভ্রষ্ট চপলের উপর ছেড়ে দিয়ে
নিশ্চিন্তে থাকো।
লিখলে সারাক্ষণই লেখা যাবে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন
সবসময়ই খারাপ, লেখার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়। মনে মনে যে দৃশ্য এখন দেখতে
পাচ্ছি, তা কিন্তু বেশ ভয়াবহ- আক্রমণাত্মক। এটা পড়তে পড়তে সারাদিনের শ্রমে ক্লান্ত
তোমার মাথাব্যথা করছে। কপাল, ভ্রু কুঁচকে আছে। রাগটা তো চোখে-মুখে ছড়িয়ে আছেই- হয়তো
সেই উত্তেজনায় কপালে, থুতনীতে, নাকের ডগায় আর উপরের ঠোটের উপরে মৃদু ঘাম ছড়িয়ে আছে।
মাথার ভেতর কয়েকটা লাইন বারবার ঘুরছে, “ধুরন্ধর শয়তান! কারণের কথা বলে যা ইচ্ছা তাই
বলে যাচ্ছে।” শাপ-শাপান্তও দিতে পারবে না- যেহেতু সেই তত্ত্বে তোমার বিন্দুমাত্র আস্থা
নেই। কাজেই আর বিপদে রাখতে চাই না তোমাকে। শান্ত হও, ভালো থেকো।
ইতি,
তোমার অ-প্রিয় রতন